• দুই বাংলার কবিতা


    প্রথম থেকেই আমরা চেষ্টা করে এসেছি ভারত এবং বাংলাদেশের বাংলা কবিতার মেলবন্ধনের। আমরা স্বীকার করি না কবিতার মধ্যে কোনো কাঁটাতার হয়। কোনো সীমান্ত থাকে। সীমানাকে অস্বীকার করাই কবির কাজ।


    দুই বাংলার কবিরা কবিতা পাঠান। আমরা অপেক্ষায় আছি।
  • কবিতা বিষয়ক গদ্য


    এই বিভাগে এক বা একাধিক কবি বা কবিতারসিক মানুষ কলম ধরছেন এই সময়ের বা চিরসময়ের কবিতা বিষয়ে। তাঁর বা তাঁদের কথাবার্তা ফুটো করে দিক প্রচলিত আর প্রথানুগ ভাবনার দিগন্তকে।


    সম্পাদনায়ঃ সনৎ মাইতি
  • অন্য গল্প


    আমরা গল্পকে গল্পের জায়গাতেই রাখতে চাই। কোনো আপত্তি আমাদের নেই। শুধু এমন গল্প শুনতে চাই যা আজ অবধি কেউ বলেনি।


    সম্পাদনায় - আবেশ কুমার দাস
  • >
  • কবিতা ভাষান


    ভাষা। সে কি কবিতার অন্তরায়, নাকি সহায়? ভাষান্তর। সে কি হয় কবিতার? কবিতা কি ভেসে যায় এক ভাষা থেকে আরেকে? জানতে হলে এই বিভাগটিতে আসতেই হবে আপনাকে।


    সম্পাদনায় - শানু চৌধুরী
  • এ মাসের কবি


    মাসের ব্যাপারটা অজুহাত মাত্র। তারিখ কোনো বিষয়ই নয় এই বিভাগে। আসলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কবিকে নিজেদের মনোভাব জানাতে চাই। একটা সংখ্যায় আমরা একজনকে একটু সিংহাসনে বসাতে চাই। আশা করি, কেউ কিছু মনে করবেন না।


    সম্পাদনায় - সোনালী চক্রবর্তী
  • পাঠম্যানিয়ার পেরিস্কোপ


    সমালোচনা সাহিত্য এখন স্তুতি আর নিন্দার আখড়ায় পর্যবসিত। গোষ্ঠীবদ্ধতার চরমতম রূপ সেখানে চোখে পড়ে। গ্রন্থসমালোচনার এই বিভাগটিতে আমরা একটু সততার আশ্বাস পেতে চাই, পেতে চাই খোলা হাওয়ার আমেজ।


    সম্পাদনায় - শিবাশিস দত্ত

Monday, May 27, 2019

।। বাক্ অনলাইন ।। ১৩৬ তম সংখ্যা ।। উপন্যাস - সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় ।।




তপোভাগ: অষ্টম পর্ব

বসুধালিঙ্গন


মাটির থেকে দূরত্ব হলে তার অসুবিধা হয়। ভূশয্যা ব্যতীত তিনি স্বস্তিবোধ করেন না। কুন্তিভোজের নির্মিত ত্রিভূমক শ্বেতাবাসটি তিনি ত্যাগ করেছেন, প্রাসাদসংলগ্ন কাননের বৃক্ষরাজির মধ্যে একটি মৃৎনির্মিত কুটিরে তিনি থাকেন। শ্বেতাবাসে থাকে শিষ্যরা। তাঁর এই কুটিরে একজনই আসে, পৃথা। 

 কুটিরটিতে দ্বার নেই। অর্থাৎ দ্বারের ফাঁক রয়েছে, তাতে বাধক কোন অর্গলবদ্ধ কাষ্ঠগঠন নেই। বাতায়নেও কোন বাধক নেই। প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য দ্বার, আলোবাতাসের জন্য গবাক্ষ, সেসব আটকাবার ব্যবস্থা থাকবার কি প্রয়োজন! তাই মুনির কথামতো দ্বার ও বাতায়নের চৌকাঠ খুলে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে কীটপতঙ্গ পশুপাখি বা সর্পাদির এখানে প্রবেশে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। 

 রাত্রি তৃতীয় প্রহরের শেষ দণ্ড। কুটিরে প্রবেশের সময় পা দিয়ে ভূমিতে কয়েকবার আঘাত করলেন আত্রেয়। সর্পাদি সরীসৃপেরা যদি থাকে, সরে যাক। সারমেয়ও বসতি করতে পারে কোন। সে অবশ্য গায়ে পা পড়লেই কামড়াবে এমন নয়, তবু, রাত্রির এই শেষান্ত প্রহরে কোন বিশ্রামরত প্রাণীর শরীরে পা দিয়ে ফেলাটা অমানবিক। ওঠো, জাগো হে প্রাণী, চলে যাও তো যাও, থাকলে থাকো, আমাকে একটু বিশ্রাম করতে দাও, আজ বড়োই পরিশ্রম গিয়েছে!

 কৃষ্ণপক্ষ। দেব চন্দ্রমা অপসৃত। তারকার আলোকে অবশ্য সবই দেখা যায়, চরাচরে মায়া লেগে থাকে। 

কুটিরের মধ্যে থেকে একটি ধড়মড় শব্দ হলো, সতর্ক হলেন আত্রেয়, সারমেয়র থেকেও বড়ো কোন পশু? অরণ্য তো এই আবাসের লাগোয়া। 

 একটি মনুষ্য অবয়ব। পৃথা।  যেন বা ঝুঁঝকো আঁধার থেকে জন্ম নিলো এক মৃদু স্বর  -- ক্ষমা করুন আর্য। আমি তন্দ্রাজড়িত হয়ে পড়েছিলাম। 

 ঘট থেকে তাঁর পায়ে জল ঢেলে দিচ্ছে পৃথা। মার্জনা করছে পদদ্বয়, স্খালন করছে পদলিপ্ত পথমল। আত্রেয় লক্ষ্য করলেন, তিনি শিথিল বোধ করছেন।


*       *       *       *       *

মানুষের অস্তিত্বের একটা উত্তাপ আছে। এক স্পন্দন আছে, তার তরঙ্গ পাশের মানুষের গায়ে যায়ই। সে যতোই নিজেকে বিলীন করে দিতে চা'ক, যতোই নিজেকে কীটাণূকীটের তুল্য তুচ্ছতায় স্থাপন করুক, সে থাকে। সে আছে। 

 নিস্তব্ধ কুটিরের বাতাসে পৃথার শ্বাস রয়েছে, যদিও পৃথা তার প্রতিটি শ্বাসের শব্দও গোপন করছে, তবুও আছে। তার উপস্থিতিতেই গৃহাভ্যন্তর সুগন্ধময়। কৃত্রিম সমস্ত গন্ধ অপছন্দ করেন মুনিবর, ফলে তার কুটিরে গন্ধের কোন উপাদান থাকেনা, পৃথা নিজে কোন সুগন্ধী ব্যবহার করেনা এই কারণে আজকাল, তবু তার উদ্ভিন্নবয়সের দেহবাস ছড়িয়ে আছে কুটিরাভ্যন্তরে। ওকে চলে যেতে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে আত্রেয়র অথচ ওকে যেতে বলতে মন চাইছেনা!

*       *       *       *       * 

শরীরে আর অবসাদ নেই। পৃথা অবসাদ পার হয়ে গেছে। ধীরে, অতি ধীরে সে মুনির পদসংবাহন করে চলেছে। মুনি ঘুমিয়েছেন কি না বোঝা যাচ্ছেনা। এই সময়টি খুবই সমস্যার। যদি জেগে থাকেন, পৃথার হাত থেমে যায়, উনি রুষ্ট হবেন কি না জানা নেই।  আবার, যদি উনি নিদ্রাবেশের শুরুর মুহূর্তে থাকেন, পৃথার হাতের অধিক চাপে তাঁর নিদ্রাভঙ্গ হয়ে যাবার সম্ভাবনা। কি জ্বালা! অথচ, উনি কিছু বলছেনও না। বাক্যব্যয় কমই করেন মুনি। 

লম্বা একটা শ্বাস নিলেন মুনি। পৃথা তার হাত সংযত করলো। আর একটুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। এই শ্বাস মুনির গাঢ় নিদ্রার প্রমাণ। 

সদ্যোজাত শিশুর মতো দুই হাত মাথার দু'পাশে। পা দুইটি মাঝেমধ্যেই একটি অপরটির ওপর চেপে যায়। একটু পরেই দুটি পা দু'দিকে ছড়িয়ে পড়ে। শিশুর মতো ঘুমোচ্ছেন মানুষটি, যেন দুরন্ত ক্রীড়াক্লেশক্লান্ত কোন বালক ঘুমোচ্ছে। শ্মশ্রগুম্ফে আবৃত মুখ অল্প ফাঁক হয়ে আছে। উন্নত উজ্জ্বল কপালে শূলচিহ্ন এখন বিলীন, মস্তকের যাবদীয় ছেলেখেলা নিদ্রাদেবীর কাছে গচ্ছিত রেখে, মুনিবর ঘুমোচ্ছেন। সারা ঘরে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর শরীরের পুরুষগন্ধ ও উত্তাপ। 

 পৃথার ইচ্ছে হলো মুনির শরীরের ওপর উপুড় হয়ে তাঁর বুকের ঠিক মধ্যিখানে মুখ রাখতে। 

পৃথা চমকে উঠলো। আজকাল এমন অদ্ভূত অদ্ভূত কিছু অনুভূতি হয় তার। অধিকাংশই এই মুনিকে নিয়ে।   পৌর্ণমাসীর দুইদিন পরে যেমন, প্রভাতে ফেরার কথা মুনির, তাঁর প্রধান শিষ্য ফিরে এসে বলেছিলেন দ্বিপ্রহরের আগেই উনি এসে যাবেন, দ্বিপ্রহর পার হলো, ক্রমে ক্রমে দিবাভাগ পেরিয়ে সন্ধ্যা নামলো, চন্দ্রমায়ালোকে ভেসে যাচ্ছে চরাচর, অন্যমনস্ক পৃথা হঠাৎ মুনির গায়ের গন্ধ অনুভব করে চমকে উঠলো। তবে কি তিনি এসে গেলেন? কই, না তো, কুটিরের বাইরে কেউ নেই! তাহলে গন্ধটা এলো কোত্থেকে! হতভম্ব হয়ে পৃথা ভাবতে থাকে, এ কি হলো! তার চোখের পলকপাঁতির ভেতর থেকে দুই চোখে ব্যথা উপচে দিয়ে নেমে আসতে থাকে জল, ঠোঁট কাঁপতে থাকে অল্প অল্প, কেউ কোথাও নেই, একা একা, পৃথা বুঝতে পারেনা, সে কেন কাঁদছে!

 সলতে টেনে নিয়ে প্রদীপটি নিবিয়ে দেবার আগে আর একবার মুনিকে দেখে পৃথা। তার বুকের ভেতর কেমন একটা হতে থাকে।

*       *       *       *       *       *       *


নারী যখন জলের সঙ্গে কথা বলে, মাঝখানে ঢুকতে নেই। 

অতি ক্ষীণা এই নদী, গভীরও নয় তেমন। আড়াআড়ি অবশ্য হেঁটে পেরোনো যায়না দীর্ঘাকৃতি পুরুষের পক্ষেও। সে খানিকটা সাঁতার দিয়ে নিলেই চলে। রাজপুরীর গা ঘেঁষে বইছে এই নদী। নদী পার হলে অরণ্য। 

তাঁর পদক্ষেপ সর্বদাই স্বচ্ছন্দ, কোথাও বাধে না। রাজপুরী ছাড়িয়ে উত্তরদিকে একটি স্থানে নদীটি কিঞ্চিৎ শীর্ণা, সেদিকে চলছিলেন আত্রেয়। মন বিভিন্ন চিন্তায় ব্যস্ত হলেও মনের একটা অংশ আশেপাশে নিয়োজিত। দৃষ্টির পারে কোথাও কিছু লক্ষ্য করে তাঁর হাঁটা শ্লথ হয়ে গেল।

বনের ধারে, নদীর অপর পাড়ে, কিছু একটি নড়াচড়া টের পেয়ে তিনি থেমে গেলেন।  প্রথমে ভেবেছিলেন কোন বন্যজন্তু, জল খেতে এসেছে অথবা গা ডোবাতে। তারপর লক্ষ্য করলেন, একটি নারী। কৃষ্ণাঙ্গী। স্নানরত। অথবা জলকেলিরত। 

বনে যাবেন তিনি? এখন? এখন এই পথ পেরোতে গেলে মেয়েটিকে সচকিত করে দেওয়া হবে। মেয়েটি সম্পূর্ণ উলঙ্গ, সেটা সামান্যই ব্যাপার, সে তো অঙ্গ ঢেকে নেবে সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু এই নারীর মগ্নতা ভঙ্গ করে দেওয়া কি উচিৎ?

নারী যখন জলের সঙ্গে কথা বলে, তখন বিশ্বসংসারে শুধু নারী আর জলই থাকে।

My Blogger Tricks

0 comments:

Post a Comment