Thursday, June 6, 2019
এ উপন্যাসের
লেখক ত্রিদিব। এর আগেও সে উপন্যাস লিখেছে, ছাপা হয়নি। অপ্রকাশিত উপন্যাসটির শেষ
লাইনে ত্রিদিব লিখেছিল, 'আমি নতুন ভাষার জন্ম দিই ; আমিই পরম ব্রহ্ম।' সে যাই
লিখুক, তাঁর লেখা কেউ পড়ে না, ছাপাও হয় না।কেউ বলে, ত্রিদিবের লেখা বোরিং। এক
বৃদ্ধা ত্রিদিবকে একবার বলেওছিলেন, 'পড়তে ইচ্ছে করে, পড়ে ভালো লাগে এমন গল্প
উপন্যাস লেখো না কেন...।' ত্রিদিব এরকম লিখতে পারে না। অথচ না লিখেও বাঁচা সম্ভব
নয় ওর পক্ষে। কথাকারের এরকম এক মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনে এ উপন্যাসের জন্ম।
ত্রিদিব
'যন্ত্রণার উৎসারণ অপনোদন বিকিরণ' ঘটাতে চায়। তাই সে লেখে। ওর মনের গভীরে একটা
আতঙ্ক আছে। 'নিজেকে না-খুঁজে পাওয়ার আতঙ্ক।' ওর একটা টেনশন আছে।
এই
টেনশনবিদ্ধ ত্রিদিবের মধ্যে গোপালবাবু এবং মিহিরকে (উপন্যাসের দুটি চরিত্র) ভেবে
নেওয়ার উপাদান মজুত। সব মিলিয়ে মিহিরদের বাড়ির গল্প, গোপালবাবুর ডায়েরি, বৈজ্ঞানিক
দিবাকর সেনকে ছুঁয়ে থাকে এ
উপন্যাস।
মিহির
নামটার মধ্যে এক ধরনের অভ্যস্ততা আছে। উপন্যাসে পড়ি : 'মিহিরদের স্বভাবত বৌ থাকে,
বাচ্চা, কুঁচকিতে দাদ, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, রাজনৈতিক সমর্থনের পার্টি।' মিহির
নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, সরকারি পরিবহন কর্মী। মিহিরের বাবার একটা মুদি
কাম-স্টেশনারি দোকান আছে। গোপালবাবু ('গোপাল বড়ো সুবোধ বালক') ন্যাদোশপনার জন্য
পরিচিত, মিহিরের বাড়িতে ভাড়া থাকে। 'গোপালবাবু মিহিরের কাছে চিরকালই একটা অপচয়,
রহস্যময়তা।' তবে গোপালবাবুর ডায়েরি এ উপন্যাসের একটা মূল বিন্দু।
উপন্যাসটি
দুটি পর্বে লেখা।
এক.
নিরন্তর প্রব্রজ্যায় : দ্বিতীয় খসড়া,
দুই . বুলা, তোমাকে।
একটা
উপন্যাস কী করে লেখা হবে, অনেক প্রশ্ন, ভাবনার অনেক ভাঙচুর শেষে দ্বিতীয় খসড়ায়
পৌঁছোনো( আসলে দুইয়ের চেয়ে অনেক বেশি খসড়ায় লেখা এ উপন্যাসের প্রথম পর্ব )--লেখার
উত্তেজনার কত না প্রহর পেরোতে হয়েছে লেখককে। তদুপরি লেখক নিজেই জড়িয়ে গেছেন এ
আখ্যানে। প্লটনির্ভর কোনো গল্প নয়, এ এক মেটা-ন্যারেটিভ। মিহির, ত্রিদিব,
গোপালবাবুরা নিজের মতো করে কিছু একটা খুঁজছেন। কী খুঁজছেন? একটা একেশ্বর ব্রহ্মাণ্ড?
আর বৈজ্ঞানিক দিবাকর সেন নিজের গবেষণায় হারিয়ে যাচ্ছেন। শুধুই আকাশ, কসমিক দুনিয়া
নিয়ে ভাবত দিবাকর। ভাবতে ভাবতে ব্রহ্মাণ্ড রহস্যে উপগত হয়। গোপালবাবুর ডায়েরিতেও
পদার্থবিদ্যার প্রসঙ্গ এসেছে। অন্যদিকে মিহির গোপালবাবুর ডায়েরির রহস্যে পৌঁছোতে
চায়-- যদিও রহস্যের সমাধান চায় না। এ সবের মাঝে গোপালবাবুর মনখারাপ হয়, তাছাড়া তার
শরীর-সম্পর্কিত কিছু দুশ্চিন্তাও আছে। আর মিহির একসময় মৃত্যুর কথাও ভাবে। নিজের
সঙ্গে নিজের কোনো কথোপকথন ছিল না মিহিরের, ও এমন আত্মচ্যুত হয়ে পড়ল কেন? উপন্যাসে
পড়ি :
'মিহিরের
অন্ত্র স্নায়ু হৃৎপিণ্ড বেরিয়ে আসে শরীর থেকে। একটা বায়ব তরল ক্কাথ নির্মিত হতে
থাকে। নির্গলিতার্থ তরল কঠিন ক্কাথ, জীবন জন্মায়, জীবন মরে গিয়ে মেশে, শরীর থেকে
মস্তিষ্ক বাইরে, মস্তিষ্ক থেকে স্মৃতি, তুমি হাতড়াও...।'
মিহির যে
তার অভ্যন্তরকে এমন আলোড়িত হতে দেখে, বারবার আলোড়নে পৌঁছোতে চায়, সে কোন মোক্ষে
পৌঁছোতে চায়? আসলে মিহির এ যাবত কোনো উদ্দেশ্য সন্ধানে পৌঁছোবার চেষ্টা করেও
পৌঁছোতে পারেনি। এ এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক সংকট। জীবন অর্থহীন হয়ে পড়লে অস্তিত্বের
যে সংকট দেখা দেয়, মিহির-ত্রিদিব-গোপালবাবু, সকলেই সে সংকটে ধস্ত হয়। এ সংকট, এ
বিষণ্ণতা ত্রিদিবেরও। আহার, বিহার আর মৈথুনে যে জীবন তৃপ্ত হয় না, সে অভিজ্ঞতা
ত্রিদিবকেও প্রশ্নমুখী করে তোলে। ত্রিদিবের বিষণ্ণতা কেন? উপন্যাসে পড়ি :
'যৌনতার
সেই আদিম আগ্রহের বাতাসেও ত্রিদিবের মৌল বিষণ্ণতা, মৌল একাকিত্ব। নিজেকে অন্যের
ভিতর খুঁজে না-পাওয়ার বিষণ্ণতা, একাকিত্ব।'
উপন্যাস
পাঠের মাধ্যমে আমরা জেনেছি কেয়া আর ত্রিদিবের সঙ্গে নেই। এও তো এক অভাববোধ, এক
ধরনের পারিবারিক শূন্যতা। মিহিরের বৌ আছে, ত্রিদিব মিহিরের ঘরে গিয়ে বসতে চায়।
মিহিরের একটা পরিবার, মানে এক ধরনের সমগ্রতা। মিহিরের অনুপস্থিতিতে, মিহিরের বৌ,
বাচ্চা, পরিবারকে ত্রিদিব দেখতে চায়।
ত্রিদিব
কি সত্যিসত্যিই মিহিরের ঘরে গিয়ে বসে? না, মিহিরের বাড়িতে ঢোকে না ত্রিদিব।
উপন্যাসের প্রথম পর্ব শেষ হয় যে বাক্যের মাধ্যমে : 'একটা বাড়ির সামনে, বাইরে,
অন্ধকারে, রাস্তার উপরে এই ভাবে আর কতক্ষণ : .... ত্রিদিব হাঁটতে শুরু করে ফের।'
মিহির,
গোপালবাবু, ত্রিদিব, দিবাকর-- সকলের জীবনেই আছে অনিশ্চয়তার উদ্বেগ। সকলেই
ব্যক্তিত্বের পূর্ণতা চায়, পায় না। পাঠকের মনে হতেই পারে, এই চারজন আসলে একই লোক--
সিদ্ধান্তহীনতার কোপে পড়েছে বলে এদের সকলের জীবন ঝাপসা হয়ে গেছে, থই পাচ্ছে না।
এরকম কোনো অবস্থায়, নিশ্চয়তানির্ভর অনিশ্চিত জীবনে তাদের মনে হতেই পারে,
'মেরুমজ্জায় আর মস্তিষ্কের কোষের গভীরে কোথাও মানুষ একটা প্রব্রজ্যাকে নিরন্তর বহন
করে চলে?'
"বুলা,তোমাকে"
এ পর্বে
গোপালবাবুর ডায়েরির বেশ কিছু অংশ ছাপা হয়েছে। মিহির ভাবতে চায়, 'মিহিরের বুলা'কে
নিয়ে গোপালবাবু লিখে থাকবেন। কেন এ ভাবনা? কারণ, মিহিরের এ কথা মনে হয়েছে, সে আর গোপালবাবু আলাদা লোক নয়।
বুলা তবে কে? তার কি কোনো শরীরী অস্তিত্ব আছে? বুলা কখনো শরীরী অবয়ব, আবার কখনো বুলা একটা পথ, একটা গন্তব্য যা মিহিরকে ডাকতেই থাকে। মিহির যে বৌয়ের পৃথিবীটার বাইরে পা রাখতে চায়। মিহির একঘেয়ে জীবনটা
বদলাতে চায়। উপন্যাসে পড়ি মিহিরের ক্লান্ত মনখারাপের কথা : 'বৌয়ের কথা ভেবে একটা ভোঁতা অথচ ছেদহীন জ্বালা তার চোখে, গলার ভিতরে :
কী পেল বৌ এ জীবনে ? মিহিরের কাছ থেকেই বা কী পেল?'
পাঠক
আন্দাজ করতে পারবেন, এ ধরনের
অস্তিত্বজনিত কোনো গূঢ় প্রশ্নের অভিজ্ঞতাসুলভ ভিত্তি থাকে, জৈবিক সুখের ওজনদারি গল্প দিয়ে সে জিজ্ঞাসাকে নির্মূল করা
যায় না। মিহির ভেবে দেখেছে, যৌনাঙ্গের যে তৃপ্তিবোধে(না, ক্রমবর্ধমান অতৃপ্তিবোধ?)
পুরুষ নারীদেহকে ব্যবহার করে, তাও এক ক্ষুদ্র মৌলিক অনুভূতি। হ্যাঁ, ক্ষুদ্রই বটে।
কোনো নারীশরীর কখনো কামের তৃপ্তি ঘটায় না। পুরুষের মৌলিক অনুভূতি বলতে এক্ষেত্রে বোঝানো হয়েছে 'যৌনাঙ্গের শীর্ষদেশের চামড়ার আবরণীটার ওঠার এবং নেমে
যাওয়ার' অনুভূতি। এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৌলিক অনুভূতিকে ঘিরে পুরুষের যৌন কল্পনা
গড়ে ওঠে। পুরুষ এক ধরনের কামের আবেশে মগ্ন হতে চায়, এ আবেশকে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখতে
চায়। পুরুষের যৌন অনুভূতি যে এত ঠুনকো তা বোঝাতে ইরেক্ট পেনিসের এ বিবরণ পেশের
প্রয়োজন ছিল।
'অপরিবর্তিত
ইচ্ছাকে অনর্থক শেষহীন বহন করে চলাই সার'--এই যন্ত্রণা কেন বহন করবে মিহির?
গোপালবাবুর
ডায়েরিতে কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া কথা লেখা আছে। ইংরেজিতে যাকে বলে staccato,
তাতে যে
টুকরো কথাগুলোর পরিচয় মেলে তা হল :
১.
'মৃত্যুর ছবি কালারে না, ব্ল্যাক-অ্যাণ্ড-হোয়াইটে ভালো আসে।'
২. 'আমি
এত মৃত্যুর কথা বলি কেন? মৃত্যু, মৃত্যু, মৃত্যুভয় ?'
গোপালবাবু
এত মৃত্যুর কথা লেখেন কেন? বুলার মৃত্যু ? কোন বুলা? গোপালবাবুর বুলা? সে মিহিরের
বুলা হতে যাবে কেন? বা, হয়তো বুলার নয়, নিজেরই মৃত্যু, বা বুলাকে কোনো মৃত্যু ভেবে
লিখেছেন গোপালবাবু। এ মৃত্যু সহনীয়। এ মৃত্যু মুক্তির পথ দেখায়। যে জীবনে মিহির
কোনো মনোযোগ পেল না, সে জীবন থেকে মুক্তি পেতে মিহির মৃত্যুবিলাসী হয়ে উঠতে পারে।
আমাদের অনুমান-- মিহিরের মনের দশা এমনও হতে পারে, 'আজকে অস্পষ্ট সব? ভালো করে কথা
ভাবা এখন কঠিন' ....
পুঁজিবাদ
একটা ব্যবস্থা। জীবন, জীবনের তো একটা কোনো অর্থ গড়ে এ ব্যবস্থা। যন্ত্রজীবন
ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য, রুচি হরণ করে-- এও সত্য। অমানবিক ব্যবস্থার কারণে ব্যক্তির
মস্তিষ্কের বিকার ঘটে যাওয়াও বিচিত্র নয়। আখ্যানে ভূপতি নামের এক চরিত্র আছে।
ভূপতির ফলের দোকান। দুর্ঘটনায় ওর দুটো পা কাটা গেছে। ও খেলা ভালোবাসে। খেলার
উত্তেজনায় ভূপতিকে চীৎকার করে বলতে শোনা গেছে, 'দে, দে শালা বাঞ্ছিত কাটাদের ধরে হজে পাঠিয়ে।' মিহির
দেখতে পায়, ভূপতি ঠিক এ কথাগুলো বলতে চায়নি, ওকে দিয়ে বলিয়ে নেওয়া হচ্ছে, ওর কোথাও
একটা গুলিয়ে গেছে। এমন গুলিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘটে গেছে মিহিরের
জীবনেও--। 'মিহির একটা স্বপ্ন, ছোটোবেলা থেকে খুঁজছে, ঘটবে, কিছু একটা ঘটবে '...
এমনটা
ঘটে না কেন? মিহির পাড়ার মনুর মতো হিরো হতে পারেনি, সংসারজীবন ব্যর্থ বলে মনে
হয়েছে তার-- মিহির বাঁচবে কেমন করে? ছেলের কথা মনে পড়ে মিহিরের। ছেলের পিঠে হাত
দিয়ে ও ফের কিছু কথা বানায়। কথা বানিয়ে বানিয়ে মিহিরের দিন কাটে।
মানুষ
যখন তার অস্তিত্ব সম্পর্কে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে, তখন মনের ভাব প্রকাশের জন্য তার
এক ধরনের দার্শনিক অনুভূতির প্রয়োজন হয়। কোনো তত্ত্বকথা বা নীতিবাক্য নয়, মানুষ
তখন জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সত্যের উপলব্ধিতে পৌঁছোতে চায়। অস্তিবাদ এ কথাই বলে।
কিয়ের্কেগার্ডের
ভাষায় :
Life has
its own hidden forces which you can only discover by living.
মিহির এ
জীবনকে আবিষ্কার করতে চায়।
এ
উপন্যাস আদ্যন্ত experimental. রিঅ্যাক্টিভ, কখনো, বার্তের ভাষায়-- moved by
indignations, আবার minor paranoias-ও মিলবে এ আখ্যানে। এক
ধরনের hallucinatory realism-এর ব্যবহারও লক্ষ করা যায়। এ আখ্যান পড়তে হলে
পোস্টমডার্ন নভেল পাঠের মেজাজ থাকা চাই।
ত্রিদিব
সেনগুপ্তের উপন্যাস
নিরন্তর
প্রব্রজ্যায় : দ্বিতীয় খসড়া
বুলা,
তোমাকে
অবভাস/সত্তর
টাকা
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
ত্রিদিব সেনগুপ্তের আসল নাম দীপঙ্কর দাশ
ReplyDelete