আমার সফর - চতুর্থ পর্ব
পরেরদিন ভোর চারটের আগেই আমরা ব্যাগপ্যাক করে বাংরিপোসির পাহাড়চূড়া থেকে
নেমে যেতে থাকলাম ছোট ছোট তিনটে দলে ভাগ হয়ে গন্তব্য গ্রামের দিকে। কে কোন দলে,এবং
সে কোথায় কোন গ্রামে যাবে, আগে থেকেই ঠিক করা ছিল।
গ্রাম কাছে এলে বোঝা যায় পাহাড়ের গায়ে একেবারে নিচের
দিকে, যেখানে সরু কোন জলবিভাজিকা পাহাড় বিভক্ত করেছে, সেই নালার ধারে ছোট ছোট অড়হর বা মকাইএর ক্ষেত।তারপর কিছুটা
সমতল জায়গায় খাপরার বা তালপাতায় ছাওয়া বসতবাটি।দেখামাত্র আমার মাথায় সুকুমার রায়ের
"বুড়ির বাড়ি" কবিতাটা মনে পড়ে গেছল।অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের লালগড় রামগড় বা গোয়ালতোড়ে এরকম ঘর নজরে পড়েছে। কিন্তু এতটা
সঙ্গীন অবস্থা ছিল না বোধহয়।এদের মধ্যে যারা একটু বড়লোক(!!) মানে ঘরে যোয়ান
মানুষের আধিক্য আছে তাদেরই খাপরার চালের বাড়ি।এদের কাছে যোয়ান মানুষের আধিক্যটাই
মোট সম্পত্তির পরিমান।আর খাদ্য ব্যাপারটা এদের কাছে বেঁচে থাকার শেষতম আশ্রয়।পশ্চিমবঙ্গের হোক বা ওড়িশার। ঝাড়খন্ডের হোক
বা দন্ডকারণ্যের, আমার ভারতবর্ষের পাহাড়-জঙ্গলে থাকা মানুষেরা বিনা ইস্যুতে
সুদীর্ঘ অনশন চালিয়ে যায়। আমরা দূর থেকে তাদের কংকালগুলোর ছবি তুলে এসেছি আর
আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে-সেমিনারে বলেছি দেখো কী
সুন্দর ওরা !কী সুন্দর ওদের লোকসংস্কৃতি! কী সব গানের মন পাগল করা সুর,আহা নাচের
কী বাহার!!
আমাদের দেশের সবচেয়ে সৎ, নির্ভান নিরহঙ্কারী, ও
সবচেয়ে গরীব মানুষগুলোকে আমরা পিছনে ফেলে আমাদের শিক্ষার গর্ব করি আমরা,আমরা আলোকপ্রাপ্ত,
আমরা ভ্যানগার্ড ইত্যাদি ইত্যাদি!!
ছ্যাঃ শত ধিক্কারেও এ লজ্জা লুকোন যাবে না আমাদের। আর কী আশ্চর্য দেখুন,এদের বিপরীতে আমাদের দেশের
নেতা-নেত্রীরা ততটাই ভন্ড, নির্লজ্জ, অহঙ্করী, অসৎ ও সবচেয়ে সম্পত্তির অধিকারী।
কিং আর কিংমেকারে দেশটা খেয়ে ফেলল একেবারে। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পঞ্চাশ বছর ষাট বছর সত্তর বছর পরেও যে দেশের বৃহত্তর জনগন খাদ্য
বস্ত্র বাসস্থানের নিশ্চয়তা পায়না সে রাষ্ট্র নিজেকে সুপারপাওয়ার বলে কী করে।
শুধু এই ওড়িশাতে নয়
পশ্চিমবঙ্গেও দেখেছি এদের মূল সম্পদের উৎস একটাই- দুটো শক্তসমর্থ হাত ও পা মানে
বেশি কাজ হয়।জঙ্গলের গাছ কেটে বিরান টাঁড় বাদাড় পেরিয়ে বহুদূর গঞ্জে বিক্রি করে
আসতে ক্ষমতার প্রয়োজন হয়।পাহাড়ের শক্ত পাথুরে মাটি সরিয়ে জমি বানাতে ক্ষমতা
লাগে।সেই জমির ক্ষেতে যে ফসল হয় বন্যজন্তুর হাত থেকে তাকে পাহারা দিতে ক্ষমতার
প্রয়োজন হয়। জঙ্গলের সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে বুনো জন্তুর সঙ্গে অসম লড়াইয়ে ক্ষমতার
প্রয়োজন হয়।আহত মানুষকে কাধে নিয়ে তিরিশ চল্লিশ মাইল হেঁটে ডাক্তারের কাছে পৌঁছাতে
ক্ষমতার প্রয়োজন হয়।তার উপর আছে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট এবং জান্তব প্রশাসন।খরগোশ
মেরে জেল খেটেছে এরকম মানুষের সংখ্যা অল্প নয়। গাছকেটে ধরা পড়লে শাস্তির হরেক
কাহানি এদের কাছে শুনছিলাম। আমরা একটাদিন জিরিয়ে নিচ্ছিলাম কেবল ট্রেনিংয়ের তোড়জোড়
করতেই।সেই সুযোগে এখানকার মানুষের রহনসহন হালহকিকত জেনে নেওয়া যতটা পারা যায়।
খেড়িয়া ও
মুন্ডাদের গ্রাম। এ তল্লাটে সাঁওতাল ও ভুমিজদের গ্রামও আছে।অনেক গুলো গ্রামের
মধ্যে মধ্যে একটা করে সিংহমহাপাত্রদের গ্রাম।সে গ্রামকে এরা ভয় পায়,সমীহ করে
চলে।ওরা বড়লোক।যেটুকু ভালোজমি এ তল্লাটে আছে তার সবটাই ওদের দখলে।এরা সেখানে কাজ
পায় বটে, তবে বছরে মাসদুই মাত্র।তখন মজুরদের বেতন ছিল আঠারো টাকা আর এক পাই মুড়ি।ওই
মুড়ির উপর এদের লোভ ছিল সাংঘাতিক।এখানকার সিংহ বা মহাপাত্ররা পশ্চিমবঙ্গের
মহাপাত্রদের মতো অতটা বড়লোক বা জমিদার নয়।এখানে জমির পরিমান বেশি নয়।তিনফসলিও
নয়।সেচের ব্যবস্থা ভালো নয়।জমির চরিত্রও আলাদা। ফলত উৎপাদন কম। কেবল ডাল জাতীয়
শস্য,বাদাম তিল তিসি অড়হর মুসুর এসমস্তই বেশি হয়।কোন কোন গ্রামে ঢালজমিতে টোবাকো
বা তামাক পাতার চাষও আছে। তবে সরকারি চাকরি ও ব্যবসাবানিজ্যে এরাই মাতব্বর।
এই যে অনেকগুলো গ্রামের কথা বলছিলাম না? পাঠক হয়তো
ভাববেন এ গ্রাম গুলো একলপ্তে আছে। না। এক একটা গ্রাম থেকে অন্য বসতির দূরত্ব প্রায়
পাঁচসাত কিমি।মাঝে পাহাড়জঙ্গলের দুস্তর ব্যবধান।গোটা এলাকা টা ছড়িয়ে আছে শখানেক
বর্গমাইলের মতো।
এখান থেকেও মানুষ নামাল খাটতে
যায়।পশ্চিম মেদিনীপুরের মানুষ যায় পূর্ব দিকে-ঘাটাল, পাঁশকুড়া, আরামবাগ, হুগলী, হাওড়ায়। আর এখানের মানুষ যায় দক্ষিণ দিকে জলেশ্বর,
বালেশ্বর, কটক, ভুবনেশ্বরে। ভুমিজ, মাহাতো, মুন্ডারি, সাঁওতালরা যায়। খেড়িয়ারা যায়না। তারা থাকে অপেক্ষাকৃত পাহাড়ের মাথার
দিকে,জঙ্গলে। এরা অনেকটাই জঙ্গল নির্ভর জনগোষ্ঠী। এদের গায়ের রং ফরসা। সাঁওতাল
বা মুন্ডারিদের মতো কালো নয়। মাহাতো জনগোষ্ঠীর লোকেরাও ফরসা হয় সাধারণভাবে। তবে
রোদেজলে ভিজেপুড়ে রং তামাটে দেখায়।
পনেরো দিনের এক দুরন্ত মিলিটারি ট্রেনিং হয়েছিল
আমাদের। ট্রেনিং দিয়েছিলেন যিনি তিনি একজন মহিলা। নাম কমলাক্কা। অন্ধ্রা থেকে
এসেছিলেন তিনি।খুব কড়া,মিলিটারি ধাঁচের মহিলা।পনেরো দিনে প্রত্যেকের দশকেজি করে
ওজন কমিয়ে দিয়েছিলেন!!
ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হয়েছিল আমাদের।
ট্রেনিংয়ের ক্যাম্পের অবস্থান বদল হত প্রতিদিন। সকাল থেকে
সারাদিন ট্রেনিং চলার পর সন্ধ্যা হলে ব্যাগপ্যাক করে আবার অজানা পাহাড়ের দিকে
পাড়ি।সারাদিন মিলিটারি ট্রেনিং করে সন্ধেবেলা আমাদের শরীর মন অবসন্ন হয়ে ভেঙে পড়তে
চাইত।কিন্তু কড়া ট্রেনারের কঠোর নির্দেশ অমান্য করার উপায় ছিলনা।প্ল্যাটুনের
সুরক্ষা সবার আগে।প্রশাসনের কাছে আমাদের উপস্থিতি ও অবস্থানের খবর পৌঁছে যাওয়ার
আগেই জায়গা বদল হওয়া জরুরি। তাই অনিচ্ছা সত্বেও
বেরিয়ে পড়তে হত।কেবল অসুস্থতা ও জরুরি প্রয়োজনেই কেউ গ্রামে থেকে যেত।এই অবস্থায়
দশ-বারো কিমি দূরের কোন গ্রামে অস্ত্র ও ভারি ব্যাগ নিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় হেঁটে
যাওয়াটাকে অমানুষিক বলেই মনে হত।অবশ্য পরবর্তী জীবনে এই কষ্টটাকে আজ আশীর্বাদ বলেই
ভাবি।যে কোন কঠোর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে উত্তরণের ফলে মানুষের মনে এক দৃঢ়তার জন্ম
হয়,সেই শিক্ষা তাকে পরবর্তী জীবনের বাধাগুলি সহজভাবে অতিক্রম করতে সাহা্য্য
করে।নিম নিশিন্দা তিতো হয়, কিন্তু খেলে উপকার
হয়।
এভাবে একদিন একদিন করে চলতে চলতে কখন যে বোম্বে রোড পেরিয়ে চহালা,
জোরান্ডা,বেরেহিপানি,পূরুনাপানির দিকে চলে এসেছিলাম বুঝতেই পারিনি। বেরেহিপানিতে আর জোরান্ডায় ওয়াটার ফলস আছে। আরো
কত ছোট বড় ঝর্ণা দেখেছি যে গুলোর নাম আজ আর মনে নেই। এ দিকটা সিমলিপাল অভয়ারণ্যের
কোর এরিয়া।গড়জাট পাহাড়শ্রেণীর টুঙ্গিবুরু(আদিবাসীদের ভাষায়)এখানকার সর্বোচ্চ
শৃৃঙ্গ। ভূূূগোল বইয়ের ভাষায় মেঘাসিনি। জনবসতি প্রায় নেই। সত্তরের দশকে সিমলিপাল টাইগার
প্রোজেক্ট ঘোষনা হওয়ার পর বেশ কিছু গ্রামকে জঙ্গলের কোর এরিয়া থেকে বাইরে
পুনর্বাসন দেওয়া হয়।শুধু মাল-খেড়িয়াদের পাহাড়-জঙ্গল থেকে তাড়ানো যায়নি। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, "বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা
মাতৃক্রোড়ে।" হয়তো
এখান থেকে সরিয়ে নিলে মাতৃক্রোড়হারা শিশুর মতোই অবস্থা হত ওদের। চহালা, জোরান্ডা এলাকাটা
বাংরিপোসির উত্তর অংশের মতো নয়। সিমলিপালকে বোম্বেরোড দু’ভাগে ভাগ করেছে উত্তর
দিকটা রগুগোড়া,নিচিন্দা, কেচকি,রাইরাঙপুর রোড ইত্যাদি।দক্ষিণে আছে বাকি ৭৫ ভাগ
অংশ।
সিমলিপালের দক্ষিণ অংশে এখন(২০১৮থেকে)আর কোন গ্রাম নেই বলেই শুনেছি। তখন মাল খেড়িয়া,হো আর
কিছু ভুমিজ গ্রাম ছিল।
যাঁরা জঙ্গলের উপরেই নির্ভর করত। ১৯৮০ সাল থেকে বারিপদা ভুবনেশ্বরে আদিবাসীদের
বেশকিছু সংগঠন তাদের জল-জমি-জঙ্গলের দাবীতে পথে নামে। এরফলে মূলবাসীদের মাটি থেকে
উৎখাত হতে হয়নি। সরকারের মোটো ছিল সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভ হলে
এখানের মানুষগুলো বাঘের পেটে যাবে।কিন্তু সেটা তো হয়ইনি, উল্টে বাঘগুলোই গায়েব হয়ে
গেল!
পরে দেখেছি রাইরাঙপুর রোডে রাত্রে গাড়ি থামিয়ে
হেডলাইটের আলোয় জংলী পশু মেরে আশপাশের বিত্তবান মানুষদের উল্লাস । আমরা একবার
সেরকমই একটা দলের মুখোমুখি হয়েছিলাম রাতের জঙ্গলে। সে এক কান্ড বটে....
0 comments:
Post a Comment