Sunday, June 9, 2019
কবি
মণীন্দ্র গুপ্তর রামকৃষ্ণ চেতনা
অনুপম
মুখোপাধ্যায়
রামকৃষ্ণ
পরমহংসকে আমরা সাধক রূপে জানি, যুগপুরুষ রূপে মান্য করি। বাঙালির জাতীয় জীবনে এই
মানুষটির ভূমিকা অপরিসীম। মুমূর্ষু হিন্দুসমাজকে তিনি নতুন প্রাণ দিয়েছিলেন, ভাষা
দিয়েছিলেন তার আত্মার মুক্তিকামনাকে। প্রায় নিরক্ষর একজন মানুষের মুখ থেকে নিঃসৃত
কথামৃত আজও আমাদের বিহ্বল করে। এত প্রজ্ঞা একজন গ্রামীন মানুষ কোথায় পেলেন!
প্রথাগত শিক্ষা থেকে প্রায় দূরে থেকেও কী করে তিনি যুগান্তরের ঋষিদের মতো আমাদের
দৃষ্টিভঙ্গিই দিলেন বদলে জীবন সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে, ধর্ম সম্পর্কে! রামকৃষ্ণর
মতো কোনো মানুষ সারা পৃথিবীতেও জন্ম নিয়েছেন বলে মনে হয় না। মানুষ জন্মায় সাদা
কাগজের মতো ফাঁকা মন নিয়ে। জীবনের অভিজ্ঞতা আর স্মৃতি সেই পাতার উপরে লেখা হয়।
কিন্তু, যুগ-যুগান্তরের প্রজ্ঞা যখন একজন মানুষের মধ্যে সঞ্চিত হয়, তখন মনে হয়
তিনি মানুষ নন, তিনি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। আমরা তাই রামকৃষ্ণদেবকে ঈশ্বর
হিসাবে মেনে নিই, মেনে নিয়ে আনন্দ পাই, স্বস্তি পাই।
এ
তো গেল একজন মহাপুরুষের সম্পর্কে আমাদের মনোভাব। আমরা অনেকেই হয়ত এটা খেয়াল রাখি
না যে, কামারপুকুরের এই অদ্ভুত মানুষটি একজন কবিও ছিলেন। কবি বলতে আজ আমরা যা
বুঝি, সেই ইমেজের সঙ্গে তাঁর মূর্তি যায় না। তিনি একটিও কবিতা রচনা করেননি,
কিন্তু, তিনি আবহমান মানবচেতনার একজন সার্থক কবি। মহাচেতনার স্ফূরণ ঘটে তাঁর
মুখনিঃসৃত বাক্যগুলিতে, যা আমরা ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’-র প্রায় প্রতি পৃষ্ঠায় পাই।
একজন স্বভাবকবির মতোই অনায়াসে রামকৃষ্ণ আমাদের চোখের সামনে আমাদের মনের কালো দরজা
হাট করে খুলে দেন আলোর সামনে বারবার। এ শুধু একজন সন্ন্যাসীর কর্ম নয়। এ একজন কবির
উপযুক্ত ভূমিকা। বাল্যকালে রামকৃষ্ণ কালো মেঘের বুকে উড়ে যাওয়া বকের সারি দেখে
আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন, সমাধিস্থ হয়েছিলেন। এ কোনো সংসারবিমুখ মানুষের ঘটনা নয়।
এই ঘটনা যাঁর জীবনে ঘটেছে, বলার অপেক্ষা রাখে না তিনি একজন কবি। এই কবির দেখাই
আমরা উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের রোম্যান্টিক কবিতাগুলোতে পাই। প্রকৃতির এক সামান্য
সাধারণ দৃশ্য থেকে সেই কবি উত্তীর্ণ হন মহাচেতনার দিগন্তপারে। কালো মেঘের সামনে
বকের সারি দেখে ভাববিহ্বল একজন বালক- এই ঘটনাই বুঝিয়ে দেয় সেই বালকের মা কালীকে
ভালবাসা আসলে বিশ্বপ্রকৃতিকে আপন করে নিতে পারার সমান, নিজেকে বিশ্বপ্রকৃতিতে
একাকার অনুভব করার সমতুল। এই স্বভাব সেই বালক সঙ্গে নিয়ে জন্মেছে, পরিণত বয়সে সেই
স্বভাব আরো বহুদূর পরিপক্ক হবে, রসস্থ হবে।
আর
ঠিক এখানে এসেই মনে হয়, মনের মধ্যে অগাধ আস্তিক্য ছাড়া যুগোত্তীর্ণ কবিতা লেখা
সম্ভবই নয়। একজন বাঙালি কবির লেখায় আধ্যাত্মিকতা আর জীবনের অপরিমেয় রহস্য যেভাবে
ধরা দিয়েছে, তাঁকে পড়তে পড়তে বারবার আমার মনে হয়েছে এই কবি রামকৃষ্ণ কথামৃতর ফসল
ঘরে তুলেছেন প্রাণভরে। তিনি কবি মণীন্দ্র গুপ্ত। মণীন্দ্র গুপ্তর কোনো কবিতাতেই
রামকৃষ্ণদেবের উল্লেখ না থাকলেও, আমার মনে এই বোধ কাজ করে গেছে যে ওই যুগপুরুষ
সম্পর্কে একটা স্থায়ী সিদ্ধান্তে এই কবি অবশ্যই এসেছেন। অবশেষে তাঁর একটি কবিতায়
আমার ধারণার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমি পেলাম। ২০০০ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল
মণীন্দ্র গুপ্তর কাব্যগ্রন্থ- ‘নমেরু মানে রুদ্রাক্ষ’। এই বইয়েরই একটি কবিতা
‘বিড়ালী’, এই মুহূর্তে পড়ছি। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে মণীন্দ্র গুপ্ত সেই বিরলতম
কবিদের একজন যাঁদের কবিতায় মানুষের আবহমান জীবন একাকার হয়ে যায় একজন
ব্যক্তিমানুষের আধ্যাত্মিকতা এবং দার্শনিক জিজ্ঞাসার সঙ্গে। বেঁচে থাকা আর প্রশ্ন
করা যখন জীবনে কিছুতেই আলাদা হয় না, শ্বাস নেওয়া আর আত্মসচেতনতার মধ্যে পার্থক্যটা
ঠিক তখনই আর দুস্তর নয়। বাঁচার আরেক নামই যে জিজ্ঞাসায় বাঁচা, এবং সেই জিজ্ঞাসা যে
প্রায়ই উত্তরের অপেক্ষা রাখে না, বরং মানুষের অপরিসীম রহস্যের তল মানুষ যে কোনোদিন
পাবে না, আর এটাই যে বাঁচার অপার বিস্ময়, মণীন্দ্র গুপ্তর অনেক কবিতা আমাদের সেই
বোধে নিয়ে যায়। এই বোধই ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’-র ছত্রে ছত্রে আমরা পাই। পেয়ে নত হই।
জীবনকে সহজভাবে নিতে আমাদের সুবিধা হয়।
‘বিড়ালী’-র
মতো অতলস্পর্শী অথচ সহজ একটি কবিতা যে দুই শতাব্দীর এবং দুই সহস্রাব্দের
সন্ধিক্ষণে বাংলায় লেখা হয়ে গেছে, লিখেছিলেন একজন প্রবীণ কবি, ভাবলে আশ্বস্ত লাগে,
নিজের মাতৃভাষার প্রতি আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে আমার মনে। ‘বিড়ালী’-র মতো কবিতা হয়ত
পৃথিবীতেই খুব কম লেখা হয়েছে। এই কবিতা
লেখা যায় না, কোনো কবিই পরিকল্পনা করে, এমনকি নিজের অগাধ জীবন-অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির
সম্ভার খুলেও এমন একটি কবিতা ইচ্ছা অনুসারে যখন তখন লিখে ফেলতে পারবেন না। এমন
কবিতাকে দিব্য প্রাপ্তি বলে মনে হয়, যেন কবিতাটি লেখা হয়েই ছিল বিশ্বচরাচরের
মধ্যে, বিশাল এক পাথরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটি মূর্তির সম্ভাবনা যেমন, কবি শুধু
তাকে খুঁজে নিলেন, একজন সাধকের মতো, বের করে আনলেন, একজন অন্বেষকের মতো, হয়ত
অনুবাদই করলেন, একজন অ্যালকেমিস্ট যেমন পারদকে সোনায় পরিণত করেন।
খুব
ক্ষুদ্রায়তন কবিতাটি-
বিড়ালী
বেড়ালটা
সকাল থেকে কাঁদছে
কাল
থেকে ওর বাচ্চাটা নিখোঁজ।
আমি
রাতের বেলা রামকৃষ্ণ কথামৃত পাঠ করছিলাম,
সে
শান্তির আশায় এসে দুই থাবা জোড় করে বসল।
কিন্তু
হল না।
একটু
পরেই সে মিউমিউ করে আবার কাঁদতে লাগল,
পাগলের
মতো প্রদক্ষিণ করে ঘুরতে লাগল।
আর
পুত্রশোক আগুনের মতো ঘিরে ধরল
রামকৃষ্ণদেবকে।
পাঠক,
দেখতেই পাচ্ছেন আমাদের প্রতিদিনের ভাষায় কবিতাটি লেখা হল। আলাদা করে কোনো কাব্যিক
অনুষঙ্গ বা উপকরণের আয়োজনই করা হল না। এক নগ্ন ভাষা এই কবিতাকে তার জীবন দিয়েছে,
তার প্রাণসঞ্চার করেছে। ভাষার এই নগ্নতা কিন্তু রিক্ততা নয়। এই নগ্নতা সকল ঐশ্বর্য
অতিক্রম করে একজন কবিকে অর্জন করে নিতে হয়। এখানে অনেক চিন্তা করে বসিয়ে দেওয়া
প্রতীক, অনেক পরিশ্রম করে গড়ে তোলা ছন্দের বাতাবরণ, অন্ত্যমিলের চমৎকারিত্ব নেই।
নেই কোনো সোচ্চার বক্তব্য, বা উপদেশ বা আবেদন, এমনকি নেই কোনো সৎ পরামর্শও।
রামকৃষ্ণদেবের
আলোয় আলোকিত এই ‘বিড়ালী’ কবিতাটিকে মনে হয় কবি যেন একটি ঋজু গাছ রচনা করেছেন। সেই
গাছ উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছে, আমরা সকালের রোদ ও অলীক কুয়াশা অতিক্রম করে
তাকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু যে প্রান্তরে সে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে চোরাবালির সমূহ
সম্ভাবনা, আমরা যে গাছটির কাছে অসঙ্কোচে নির্ভাবনায় যাব, সে উপায় নেই। এই কবিতা এক
এমনই গাছ, যার ডালে আর কোনো পাতা নেই, কবি তার সব পাতা অবলীলায় ঝরিয়ে দিয়েছেন, ঝরাতে
চেয়েছিল গাছটিই তার সকল পাতা কবির হাতে, এখন গাছটি যে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে,
যেন এক অক্ষয় অস্তিত্ব। ওই গাছকে তার স্থান থেকে কেটে ফেললেও তার আকারকে মুছে ফেলা
যাবে না। তার নির্জনতা, তার নিঃস্বতা তার স্বনির্বাচিত। সে যেন নিজেই নিজেকে জন্ম
দিয়েছে। ঠিক এখানেই একটি কবিতা ধ্রুপদী হয়, অনতিক্রম্য হয়।
কবিতার
শুরুতে খুবই আলগোছে কবি ‘বেড়ালটা’ শব্দ ব্যবহার করলেন। পরের লাইনে আছে ‘বাচ্চাটা’। এই
শব্দ দুটি এই কবিতাকে আমাদের সংসারের মধ্যে এনে বসিয়ে দেয়। এ যেন আমাদের নিজেদের
কবিতা হয়ে ওঠে। কবি কবিতার মধ্যে ‘বিড়াল’ লিখলেন না, কবিতার যে নামকরণ সেই
‘বিড়ালী’-ও লিখলেন না, কারণ ‘বেড়াল’ শব্দটার মধ্যে আছে এক দুর্জ্ঞেয় হিংস্রতার
ভাব, সে যেমন পশুর নিজের স্বাভাবিক হিংস্রতা, যার বশে সে ঘরে দুধভাত পেলেও বাইরে
গিয়ে ইঁদুর মেরে খায়, আবার বাইরের পৃথিবীর তার প্রতি হিংস্রতাও আছে তো বটেই। ‘বেড়াল’
একইসঙ্গে এক হিংস্র, বিপজ্জনক, বিপন্ন ও অসহায় পশু। তার মুখে মিষ্টতা, লোমে
কোমলতা, দাঁতে তীক্ষ্ণতা, চোখে ক্রুরতা, থাবায় রক্ত, স্তনে শাবকের জন্য দুধ। সে
একইসঙ্গে চোর, আবার শিকারী। সে একইসঙ্গে বন্য, আবার গৃহপালিত। ‘বিড়াল’ শব্দটায় তা
ঠিক ফোটে না। ‘বিড়াল’ বড্ড অফিশিয়াল শব্দ। নামকরণে মানায়, কিন্তু কবিতার মধ্যে এলে
কিছুটা অসাড় করে দেয় উচ্চারণকে।
দ্বিতীয়
লাইন শুরু হচ্ছে ‘কাল’ শব্দটা দিয়ে। ‘কাল’ এবং ‘গতকাল’-এর মধ্যে আছে পার্থক্য।
‘কাল রাত থেকে ওর বাচ্চাটা নিখোঁজ’ না লিখে মণীন্দ্র গুপ্ত যদি লিখতেন ‘গতকাল রাত
থেকে ওর বাচ্চাটা নিখোঁজ’, তাহলে এই লেখা একটা ছোটগল্পের অবতারণা করত, হয়ত একটা
সিনেমার স্ক্রিপ্ট হত, কিন্তু শাশ্বত কবিতা হত না। ‘কাল’-এর মধ্যে এক অপরূপ
অনির্ণেয়তা পেয়েছে এই কবিতা, পেয়েছে এক আশ্চর্য ধাবমানতা, যা সেই আগুন আবিষ্কারের
সময়কার মানুষের সঙ্গে আজকের ডিজিটাল মানুষকে ছুটিয়ে নিয়ে আসে পাঠকের চোখের সামনে। ‘কাল’
শব্দটার মধ্যে যে নশ্বরতা, তা পাঠককে বোধ করায় যেন তিনিও কোথাও কিছুটা দায়ী এই
বেড়াল মায়ের সন্তান হারানোর জন্য। বিড়ালী যে তার বাচ্চাকে হারিয়েছে, তার পিছনে যেন
আমার আর আপনারও কিছু ষড়যন্ত্র রয়ে গেছে, এমনই এক অপরাধবোধ আমাদের গ্রাস করে। আমরা
রেহাই পেতে চাই কবির তর্জনী ও দোষারোপের হাত থেকে।
রাতে
কবি বসেছেন ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ হাতে। লক্ষ্য করুন পাঠক, সময়টা কিন্তু রাত। দিনে
কথামৃত পাঠ নয় কেন? রাত স্বয়ং এক রহস্যময় চাদর, তার আড়ালে আমরা অনেক কিছু লুকোই। স্মরণাতীতকাল
থেকে মানুষ নিয়েছে সূর্যহীন রাতের সুযোগ। এই সময়ে একজন প্রাচীন মুমুক্ষু মানুষের
মতো রামকৃষ্ণ কথামৃত খুলে বসলেন কবি, ঠিক যেমন একজন মানুষ শহরে পথ হারালে সেই
শহরের গাইডম্যাপ খুলে বসে, অথবা, কোনো সন্ধান-অভিযানে যাওয়ার আগে খুলে বসতে হয়
এলাকার রুটম্যাপ, পথহারা জাহাজের ক্যাপ্টেনকে খুলে বসতে হয় সমুদ্রের নির্ভরযোগ্য
মানচিত্রটি। বেড়ালটি ঠিক তখনই এসে বসল তাঁর সামনে। এই বেড়াল একজন সংসারী মানুষ।
কবি তার থেকে খুব উচ্চ স্তরীয় কেউ যেন করলেন না নিজেকে। তিনি বেড়ালটির পর নন, তিনি
আমাদেরও স্বজন। আমাদের স্বভাব এবং সমাজ থেকে তিনি খুব বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যক্তি নন।
রামকৃষ্ণ কথামৃত এই বেড়ালের জন্য নয়। যাঁরা রামকৃষ্ণের ছবির বাড়িতে ঝুলিয়ে রাখেন,
তাঁরা অধিকাংশই রামকৃষ্ণের যোগ্য কিন্তু করেন না নিজেদের। এই বেড়াল তাঁদেরই একজন।
এই কবিতাটিকেও যেন ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’-রই একটি আখ্যান বলে বোধ হয়।
এই
বেড়াল শান্তি চায়। কে না চায় শান্তি? এই শান্তি বড় গোলমেলে শব্দ। মনের শান্তি হয়
অনেক উপায়ে। সব উপায়ই সভ্যতা বা সংসারের অনুকূল নয়। হত্যা করেও শান্তি পেতে চেয়েছে
অজস্র মানুষ। অন্যের ঘরে আগুন দিয়ে শান্তি পেতে চেয়েছে অজস্র মানুষ। একজন তাই শুধু
শান্তি চেয়েই নিজেকে পাশবিকতার উপরে বা বাহিরে নিয়ে যেতে পারে না। মহাভারতে শান্তিপর্ব
আছে। বিশ্বযুদ্ধে শান্তিপর্ব আছে। পৃথিবীতে আজ অবধি মানুষ যত শান্তিচুক্তি সই
করেছে, তার একটাও শেষ পরীক্ষায় ফলপ্রসূ হয়নি। শান্তি শব্দটার মধ্যেই ঝুলে থাকে
অতীত বা ভবিষ্যতে রক্তপাতের মেঘ। ঠিক বেড়ালের থাবার মতোই। কবি লিখলেন- ‘সে
শান্তির আশায় এসে দুই থাবা জোড় করে বসল। ’। লিখলেন
না – ‘দুই হাত জোড় করে বসল’। ‘থাবা’ আর ‘হাত’-এর মধ্যে অসীম পার্থক্য, এবং সেখানেই
এই কবিতার বেড়াল আমাদের সঙ্গে একই হয়ে যায়। আমরা এই লাইনটা পড়ি, নিজেদের হাতের
দিকে তাকাই, খুঁজে দেখতে চাই নিজেদের নখের কোণে এক বা একাধিক ইঁদুরের রক্ত লেগে
আছে কি না। এ আমাদের হাত, না কি থাবা? শান্তির অধিকার কি আমাদের আছে? কী যেন হারিয়েছি
আমরা, কী যেন আমাদেরই অস্তিত্বের অংশ থেকে সন্তানের মতো বিচ্ছিন্ন হয়েছে। তার
অনুপস্থিতি টের পেয়ে আমরা সশব্দে বা নিঃশব্দে কাতর হয়েছি, সেই কাতরতা থেকে মুক্তি
পেতে শান্তির ধারণায় যেতেও চেয়েছি। কিন্তু, রামকৃষ্ণ কথামৃতর যোগ্য কি আমরা হতে
পেরেছি?
কান্নাই
যথেষ্ট নয়। কান্নার শেষ নেই। কান্না থেকে মুক্তিও নেই। কান্না স্বয়ং এক সম্পূর্ণ
জীবন আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে যাপন করে। কান্না আমাদের ক্ষমাযোগ্য করবে, এমন কোনো
প্রতিশ্রুতি কোথাও আছে কি? রামকৃষ্ণ পরমহংস। তাঁকে আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে অভিন্ন চোখে
দেখি। আমাদের প্রার্থনা আর আকুলতা তাঁর দিকে দেবতার মতো ছুটে যায়। দুধ আর জল আলাদা
করে নিতে পারেন তিনি, অথচ মায়ায় জড়িয়ে থাকা রামকৃষ্ণ ঈশ্বর হয়ে আমাদের সঙ্গেই
কাঁদেন, আমরা আমাদের কান্নায় শোকমুক্ত না হই, তাঁকে হয়ত আমাদের শোকে সমব্যথিত পাই।
সে বড় কম পাওয়া নয়। এতে শোক শোকার্তর অজান্তেই সার্থক হয়। একজন অবোধের কান্নাও
ঈশ্বরকে স্পর্শ করে। শোকের আগুন তাঁকেও ঘিরে ধরে, যে শোক আমাদের মতো নশ্বর
বেড়ালদের অন্তরকে পোড়ায়, তাঁকে তা স্পর্শ করে না। যে অনুপস্থিতির অনুভব আমাদের
অস্থির করে, ছুটিয়ে মারে তিনি তার বলয়ে নিজের খেলার তাপটুকুই উপভোগ করেন, হয়ত।
শোকের অভিজ্ঞতাও তো এক সর্বত্রবিরাজমান নিয়মে খেলার অংশ মাত্র। সেখানে হারিয়ে
যাওয়া বেড়ালশাবক ঈশ্বরের সন্তান, তিনি শুধু তার অনুপস্থিতিটুকু আমাদের বোধ করতে
দিলেন, কোথাও কোনো এক সূত্রে আমরা তাঁকেও বোধ করলাম এক ফাঁকে।
মণীন্দ্র
গুপ্তর এই ‘বিড়ালী’ কবিতা পৃথিবীর সার্থক আস্তিক কবিতাগুলির সমগোত্রীয়। এত ছোট
একটি লেখার মধ্যে দান্তে আলেগিয়েরির সমগ্র ডিভাইন কমেডি যেন উঁকি দিয়ে যায়। এই
কবিতা বাংলা ভাষায় লেখা হত না যদি না তার অনেক আগে কামারপুকুরের এক দিব্যোন্মাদ
মানুষ তাঁর কথামৃত ছড়িয়ে দিয়ে যেতেন ভবিষ্যতের একজন কবির জন্য। রামকৃষ্ণও ঠিক
এভাবেই ছোট একটি আখ্যানের যেন উপস্থাপনা করতেন মানুষকে তার চেতনার সীমার ওপারে
নিয়ে যেতে। সেই আখ্যান যেমন গল্পের চেয়ে অনেক বেশি কিছু হত, এই ‘বিড়ালী’ কবিতাও
একটি লিখিত কবিতার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। কী ঈশারা কবি আমাদের দিয়ে গেলেন, এই ভাবতে
ভাবতে আমরা নিজেদের অনেক অক্ষমতা আর অসম্পূর্ণতার আভাস যেন পেয়ে যাই। সর্বোপরি, কবি
মণীন্দ্র গুপ্ত যে সফল হলেন এই অসামান্য রহস্যময় কবিতাটি আমাদের উপহার দিতে, সেই
সফলতা প্রকারান্তরে ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’-র দান।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Anabadyo.... etota gobhire jete parini ... sarthok bishleshon
ReplyDeleteকি আশ্চর্য বিশ্লেষন। আমি ভাবতেও পারিনি।
ReplyDelete